উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের পাহাড়ি ঢালে ছোট্ট একটি ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন আবদুর রহিম (৪২)। ৬ বছর আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার সময় সঙ্গে ছিল স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। আশ্রয়শিবিরে গত পাঁচ বছরে আবদুর রহিমের সংসারে জন্ম নিয়েছে আরও দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
আবদুর রহিম বলেন, মিয়ানমারে থাকতে পরিবার পরিকল্পনা কী জিনিস, জানতেন না তিনি। বাংলাদেশে আসার পর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছেন। প্রথম দিকে পরিবার পরিকল্পনায় অনীহা থাকলেও, এখন কমবেশি সবাই সচেতন।
কুতুপালং ক্যাম্পে কথা হয় রমিজা আক্তারের সাথে তিনিও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন ২০১৭ সালের দিকে। শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে কোনোরকমে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে আসেন রমিজা। প্রথম সন্তানের জন্মের ১ বছর ৯ মাস পর আবার গর্ভবতী হয়েছেন তিনি।
রমিজা থাকছেন উখিয়ার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। ক্যাম্পের মধুরছড়া এলাকাতে রয়েছে এনজিও পরিচালিত ফিল্ড হাসপাতাল । গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে এ হাসপাতালেই নিয়মিত চেকআপে আসেন রমিজা। সেখানেই কথা হয় রমিজার সঙ্গে। বলেন, ‘সন্তান নিতে চাননি, কিন্তু নিজের অজ্ঞতার কারণে সন্তান পেটে এসেছে। কিন্তু এরপর আর এমন হবে না।’
তিনি আরো বলেন, মিয়ানমারে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সর্ম্পকে কিছুই জানতেন না। কিন্তু এখানে আসার পর তিনি জন্ম নিয়ন্ত্রণের নানা পদ্ধতি সর্ম্পকে জেনেছেন এবং এখন এখন সে সর্ম্পকে আগ্রহী।’
তাছাড়া বেশি সন্তান এবং ঘণঘণ সন্তান হওয়া অনেক পরিবারের দুর্দশা তিনি নিজের চোখেই দেখছেন। এই অভিজ্ঞতাও তাকে নতুন করে ভাব ভাবতে শিখিয়েছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শতকরা ৩৯ ভাগ পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার থেকে পাঁচ জন। এর বাইরে পাঁচ থেকে আটসদস্যের পরিবার আছে ২১ শতাংশ; আর আট জনের বেশি সদস্য রয়েছে শতকরা তিন ভাগ পরিবারে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মোট ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যায় পুরুষের সংখ্যা ৫২ শতাংশ, নারী ৪৮ শতাংশ। মোট রোহিঙ্গার শতকরা ৫৫ ভাগই শিশু।
২০১৭ সালে আগস্টে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন বাংলাদেশে আসা শুরু করে তখন থেকেই ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য বড়ি ও কনডম দেওয়া হলেও এসব বিষয়ে তাদের অনাগ্রহ ছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় তাদের কোনও আগ্রহই ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি কুতুপালং ও বালুখালি ক্যাম্পগুলোতে ঘুরে সে অবস্থার পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। তবে নারীরা আগ্রহী হলেও পুরুষরা তাতে আগ্রহী নন।
ক্যাম্পের ‘উইম্যান ফ্রেন্ডলি স্পেসে’ নারীরা বলছেন, ‘নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হলেও তাতে পুরুষরা আগ্রহী নয়। এখানে যদি কোনও নারী গর্ভবতী না থাকে সেক্ষেত্রে ক্যাম্পের ভেতরেই ধর্ষিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়-এরকম একটি কনসেপশন ক্যাম্পে রয়েছে। যার কারণে এখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি একেবারেই গড়ে ওঠেনি।’
থাইনখালী রোহিঙ্গা শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা নুরু আমিন (৫৫) বলেন, রাখাইন রাজ্যে কন্যাসন্তানকে ১৪-১৫ বছরে বিয়ে দেওয়া হতো। অনেক পুরুষের একসঙ্গে চারজন স্ত্রীও রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে পরিবার পরিকল্পনাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত রোহিঙ্গারা।
আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, রাখাইনে (মিয়ানমারে) রোহিঙ্গারা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। ভবিষ্যৎ চিন্তা ও জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়াতে রোহিঙ্গারা পরিবার বড় করতে চাইত। তা ছাড়া রাখাইনে সে দেশের সেনাবাহিনী ও মগ সম্প্রদায়ের লোকজনের ভয়ে অল্প বয়সে রোহিঙ্গা কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া হতো। বাংলাদেশে আসার পরও সেই প্রবণতা অব্যাহত ছিল। তবে এখন কমে আসছে।
প্রথম যখন এসেছে তারা একেবারেই অজ্ঞ ছিল। অনেক ধরনের কুসংস্কার তাদের ভেতর কাজ করত-কিন্তু এখন তারা সেখান থেকে সরে আসছে। কিন্তু এই এক বছরে কাউন্সিলিং করার ফলে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু আরও সময় দরকার বলে মন্তব্য করেন কুতুপালং লাম্বাসিয়াতে অবস্থিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হেলথ কেয়ারের মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট মারুফ রহমান।
মারুফ রহমান বলেন, ‘আমাদের হেলথ কেয়ার গুলোতে পিল, ইনজেকশন, কনডম রয়েছে পর্যাপ্ত। তাদেরকে দিচ্ছি, নিচ্ছেও তারা। অনেকে নিজে থেকেও আসছে-যেটা আমাদের জন্য খুবই পজিটিভ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও সময় লাগবে।’
মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা তাদের নিয়ে উঠোন বৈঠকের মতো করছেন, সেখানে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে। বিভিন্ন হেয়ার সেন্টারগুলোতে যখন তারা যায়-সব জায়গায় তাদের সঙ্গে এসব কথা বলা হয় এবং তাতে করে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে-নারীরা সচেতন হচ্ছেন, বলেন মারুফ রহমান।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে পিছিয়ে ছিল। ফলে এটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও তাদের সচেতন করার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে।
পাঠকের মতামত